আমরা বাড়িতে মাকে সেলাই করতে দেখি। আমাদের জন্য জামা-কাপড়, জামার ওপর সুন্দর নকশা ইত্যাদি অনেক সূচিশিল্প তাঁরা করেন। সুই, সুতার নানারকম কাজ আমরা নিজেরাও করি। যেমন-বোতাম লাগানো, ছেঁড়া কাপড় জোড়া দেয়া, দেওয়া, ছোটোখাটো রুমাল, টেবিলের কাপড় ইত্যাদি। গ্রামে ও শহরে অনেক বাড়িতেই আমরা কাঁথা ব্যবহার করি। কিছু আছে সাধারণ কাঁথা আবার কিছু আছে নকশিকাঁথা। কাঁথায় অনেক রঙের সুতা দিয়ে সেলাই ও নকশা থাকে। দেখতেও খুব চমৎকার। কাঁথায় পাখি, মাছ, ফুল, লতাপাতা, হাতি, ঘোড়া, মানুষ ইত্যাদি অনেক কিছুই রঙিন সুতায় সেলাই করে ছবি ও নকশা আকারে তুলে ধরা হয়। আবার অনেকে ছোটো ছোটো নকশিকাঁথা ছবির মতো বাঁধাই করে ঘরে সাজিয়ে রাখে। এই যে শিল্প, একে আমরা বলি সূচিশিল্প। এই শিল্প চারুশিল্পের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। বহুকাল ধরে নানি-দাদিরা নানারকম নকশা করা পাখা, তোয়ালে, জায়নামাজ, কাঁথা ইত্যাদি সেলাই করতেন। অবসর সময় তাঁরা অনেকদিন ধরে এক একটি কাঁথা তৈরি করতেন। সুই, সুতা দিয়ে নিজেদের সুখ-দুঃখের কাহিনি নকশা করে ফুটিয়ে তুলতেন। বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে সাধারণ পরিবারের মহিলারা এখনো নানারকম নকশিকাঁথা তৈরি করছেন। এই নকশিকাঁথার পরিচিতি ও খ্যাতি লোকশিল্প হিসেবে পৃথিবীর সর্বত্র। বাংলাদেশের বিভিন্ন জাদুঘরে ও পৃথিবীর অন্যান্য সংগ্রহশালায় বাংলাদেশের এই লোকশিল্পের সংগ্রহ রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে এই শিল্পের বেশ প্রচলন হয়েছে। নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়েও বাজারে বিক্রি হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে এর কদর বেড়েছে। এই ধরনের লোকশিল্প রপ্তানি করে আমাদের দেশে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। সুচিশিল্প সাধারণত গ্রামের মেয়েরাই বেশি করে থাকে। এই শিল্প আমাদের সৌন্দর্যবোধের মান উন্নয়ন করে এবং প্রয়োজনও মেটাতে সাহায্য করে। সুই, সুতার কাজ করা রুমাল, টেবিলের কাপড়, শাড়ি, কামিজ, ওড়না, প্যান্ট, ছোটো শিশুদের ফ্রক, পর্দা ইত্যাদি দেখতে খুবই সুন্দর। আমরা নিজেরাও এ ধরনের জামা-কাপড় পরতে খুব পছন্দ করি। তাই এই শিল্প শিখে নিজ নিজ প্রয়োজন মিটিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারব। সেলাই ফোঁড়ের কাজের প্রধান বিষয় হলো নানা ধরনের ফোঁড় ও নানা রঙের সুতার যথাযথ ব্যবহার।
উপকরণ
সরু ও মোটা নানা ধরনের সুই। সাদা ও রঙিন সুতা বা উল। কাপড়ে দাগ দেওয়ার জন্য পেনসিল। প্রয়োজনমতো কাপড় অথবা চট। একটি ছোটো কাঁচি। একটি ফ্রেম (সুই-সুতায় সেলাই করার জন্য)। উপকরণ রাখার জন্য একটি বাক্স বা কৌটা। কাপড়ে মাপ দেওয়ার জন্য স্কেল বা মাপ দেওয়ার ফিতা। উপকরণ তো হলো!
এবার কাপড় বা চটে সুই, সুতা দিয়ে সেলাই করে নকশা করতে হলে আমাদের নানা ধরনের ফোঁড় জানা দরকার। সূচিশিল্প বা এমব্রয়ডারি কাজে অনেক ধরনের ফোঁড় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এখানে কয়েকটি ফোঁড় ও এগুলো কীভাবে করতে হয়, ফোঁড়গুলোর চেহারা কেমন তা বুঝতে পারব ও ফোঁড়গুলো তুলতে পারব।
ফোঁড়গুলোর নাম
১। রানিং ফোঁড় বা রান সেলাই
২। হেম ফোঁড় বা মুড়ি সেলাই
৩। বখেয়া ফোঁড়
৪। স্টেম ফোঁড়
৫। চেইন ফোঁড়
৬। লেজি-ডেইজি ফোঁড়
৭। ব্রুস ফোঁড়
৮। তারা ফোঁড়
৯। বোতাম ঘর ফোঁড়
১০। কম্বল ফোঁড়
১১। সার্টিন ফোঁড়
১২। হেরিংবোন ফোঁড়।
রানিং ফোঁড় বা রান সেলাই
বিভিন্ন ফোঁড়ের মধ্যে রানিং ফোঁড় বা রান সেলাই সবচেয়ে সহজ। যে কাপড়ের ওপরে সেলাই করব সেটিকে বাঁ হাত দিয়ে একটু উঁচু করে ধরে ডান হাতে সুঁই নিয়ে সেলাই করব। কাপড় বাঁ হাতের ওপরে রেখে বুড়ো আঙুল দিয়ে অবশিষ্ট চারটি আঙ্গুলের উপর কাপড়খানাকে চেপে ধরি, ডান হাতে সুই ধরে, একবারে ৩ থেকে ৪টি ফোঁড় করা যাবে। তবে প্রতিবারই ৩-৪টি ফোঁড় দেবার পর, সুতা টেনে সেলাইটি শক্ত করে নেব। রানিং ফোঁড় শেখার জন্য সাদা কাপড় হলে রঙিন সুতা, রঙিন কাপড় হলে সাদা সুতা ব্যবহার করব। কারণ এতে সেলাই সোজা ও সমান হচ্ছে কিনা তা সহজেই বুঝতে পারব। এই ফোঁড় দিয়ে যেমন রেখা সেলাই করা যায়, তেমনি ভরাট সেলাইও করা যায়। নকশিকাঁথায় রানিং ফোঁড় বহুলভাবে ব্যবহার করা হয়।
টেবিলের কাপড়, রুমাল, জামা ইত্যাদি কাপড়ে তৈরি যে কোনোটির কিনারা মুড়ে সেলাই করার জন্য এই ফোঁড় ব্যবহার করা হয়। টেবিলের কাপড়, রুমাল, জামা ইত্যাদি কাপড়ে তৈরি যে কোনোটির কিনারা মুড়ি সেলাই করবার জন্য যে ফোঁড় ব্যবহার করা হয় তাকে হেম ফোঁড় বা মুড়ি সেলাই বলে। এই সেলাই করার সময় কাপড়ের কিনারা এমনভাবে ভাঁজ করে নেব, যাতে কিনারার সুতাগুলো বেরিয়ে না পড়ে। এই ফোঁড় দিয়ে কুশন, জামা, শাড়ি, টেবিলের কাপড় ইত্যাদিতে অ্যাপ্লিক নিয়মে নকশা করা যায়। অ্যাপ্লিক হলো রঙিন কাপড় কেটে অন্য কাপড়ের ওপর বসিয়ে নকশা করা। হেম বা মুড়ি সেলাই শিখে নিলে আমরা অ্যাপ্লিক পদ্ধতিতে নানা রকম কাজ করতে পারব।
বখেয়া ফোঁড় সোজা দিকে মেশিনের সেলাই-এর মতো দেখতে হয়। এই ফোঁড় তুলতে হলে, রানিং ফোঁড়ের মতো নিচ থেকে ওপরে সুই চালিয়ে ফোঁড় তুলতে হয়। পরে সামান্য একটু সামনে আবার ওপরে সুই দিয়ে ফোঁড় তুলে আনি। সুই এর মুখটি আবার আগের ফোঁড়ের কাছে ফিরিয়ে আনি। পুনরায় ওপর থেকে নিচে ফোঁড় তুলি। এভাবে বার বার ফোঁড় দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাই। দেখব মেশিনের সেলাইয়ের মতো সেলাই হয়েছে। এই ফোঁড় সাধারণত জামা-কাপড়ের জোড়া লাগাতে প্রয়োজন হয়। বখেয়া ফোঁড়ের জোড়া খুব শক্ত হয়। তাছাড়া এই ফোঁড় দিয়ে নানা রকম নকশাও করা যায়। যেমন-২৫ সেমি. চওড়া ও ২৫ সেমি. লম্বা কাপড়ে প্রথমে পেনসিলে একটি মাছের ছবি এঁকে রেখা অনুযায়ী বখেয়া ফোঁড় তুলে মাছের ছবিটি ফুটিয়ে তুলতে পারি। অন্যান্য যেকোনো নকশাও বখেয়া ফোঁড় দিয়ে করতে পারব।
Read more